শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৫ অপরাহ্ন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের আধুনিক জীবনে এক নতুন বাস্তবতা। নগর-বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে চায়ের দোকানে মানুষ তথ্যের জন্য এখন আর পত্রিকার পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করে না। এর বদলে এসেছে স্মার্টফোন ও আইফোননির্ভরতা। গণমাধ্যমে তথ্যের বিপণনের সাবেকি প্রথা এখন আর নেই। চারপাশে, দেশে-বিদেশে কী ঘটছে, সেগুলো ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, গুগলসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাচ্ছে সবাই। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষ মানবিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক দূরত্বকে পুরোপুরি দূর করে দিচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে যেকোনো ব্যক্তি তথ্য, অভিমত, ছবি, ভিডিও ইত্যাদি দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম একটি সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে টুইটার। কিন্তু এই টুইটারের মালিকানা কিনে নেওয়ার পর থেকেই ইলন মাস্ক এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিটিকে একেবারে মধ্যযুগীয় জমিদারদের মতো পরিচালনা করছেন এবং সম্পূর্ণরূপে এটি এখন তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা মতো চলছে। স্পষ্টতই এই প্রযুক্তি-ধনকুবের মন থেকে বিশ্বাস করেন, টুইটারে যারা কাজ করেন, তাদের যে কারও চেয়ে তিনি সবকিছুই ভালো জানেন এবং তিনি তার এই নতুন কোম্পানিটির কর্মীদের সঙ্গে আধুনিক যুগের দিনমজুরদের মতো আচরণ করে চলেছেন। টুইটার নিয়ে ঘটনা এখন যে পর্যায়ে এসেছে, তা সম্ভবত অনিবার্য ছিল। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতির লালন করছে। এই সংস্কৃতির শুরুটা করেছিলেন স্টিভ জবস। তিনি অতি সতর্কতা ও যতেœর সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে নিজের উদার ও কৌতূহলী উদ্ভাবকের ভাবমূর্তি ধরে রেখেছিলেন; কিন্তু বাস্তবে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর-নিয়ন্ত্রিত একটি করপোরেশনের প্রধান ছিলেন। জবস সারা জীবন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তার আইকনিক অবস্থান অনুসরণ করে উঠে আসা উত্তরাধিকারীরা তার মূল্যবোধ ও আদর্শকে মোটেও অনুসরণ করেননি।
তারা তাদের নিজেদের প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিজেদের উদ্যমকে রাজনীতির হাতে সঁপে দিয়েছেন এবং নিজেদের কায়েমি স্বার্থ উদ্ধারের এজেন্ডাগুলোকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন। টুইটারের মালিকানা কেনার পেছনে ইলন মাস্কের যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, তা তিনি গত মে মাসে তার টুইটার হ্যান্ডেলে করা একটি পোস্টেই খোলাসা করেছিলেন। সেখানে তিনি ফ্রান্সের সূর্যরাজ খ্যাত রাজা চতুর্দশ লুইয়ের একটি ছবি পোস্ট করেন। এর মাধ্যমে ইলন মাস্ক নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন আলোকিত রাজা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন বলে মনে করা হয়। ওই সময় তিনি টুইটারকে একেবারে অবাধ করবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু গত দুই মাস ধরে মাস্কের কার্যকলাপ ও প্রতিক্রিয়া দেখে তাকে একজন মহান সূর্যরাজের চেয়ে কম উদার এবং একটি প্রায় ভেঙে পড়া রাজ্যের একজন আধুনিক স্বৈরশাসকের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে। একজন উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা দখলকারীর মতো তিনি গণতন্ত্র এবং জনগণের ইচ্ছার কথা বলে টুইটার দখল করা শুরু করেছিলেন, এবং এর মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্র এবং জনগণের ইচ্ছা উভয়কেই উপহাস করেছেন। তিনি নিজে যে টুইটারকে ডিজিটাল টাউন স্কয়ার বলে অভিহিত করে থাকেন, সেটিকেই তিনি এমনভাবে ব্যক্তিগত পরিসর বানিয়েছেন যেখানে তার কথাই শেষ কথা। আর দশজন স্বৈরশাসকের মতো মাস্কও ভিন্নমত ও সমালোচনার প্রতি সহনশীলতা দেখাননি। কোম্পানির মধ্যে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখানোর জন্য তিনি কর্মীদের চাকরি খেয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। একজন কট্টর কর্তৃত্ববাদীর মতো তিনি গণমাধ্যমে ঘৃণা করেন এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর খড়গ তুলতে দ্বিধা করেন না।
টুইটারকে কিনে নিয়েই মাস্ক তার নতুন সাম্রাজ্যে ঢুকলেন মূর্তিমান আতঙ্কের মতো। তিনি শুরুতেই তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং তার বিষয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনামূলক মন্তব্য করা কর্মীদের একের পর এক চাকরি খাওয়া শুরু করেন। হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টুইটার নিষিদ্ধ করেছিল; মাস্ক এসে সেই অ্যাকাউন্ট চালু করেছেন। টুইটারকে লাভজনক করার জন্য তিনি টুইটারের নীল টিক চিহ্নধারীদের মাসে ৮ ডলার দিতে হবে বলে ঘোষণা দেন। তাতে টুইটারে স্বাভাবিকভাবেই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানসিকতা ও অনন্য আইডিয়ার অনন্য মানুষ বলে যে কথা প্রচলিত আছে, ইলন মাস্কের দাম্ভিক ও অসহনশীল আচরণ সেই কথার সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। টুইটার নিয়ে মাস্ক যা করছেন, তাতে বরং সাধারণের এই ধারণা জন্মাবে যে আজকের দিনের ধনকুবেররা আগের দিনের সামন্তদের মতো। তবে মাস্কের মতো ধনকুবের এবং অতীতের সামন্ত জমিদারদের মধ্যে অবশ্যই কিছু পার্থক্য আছে। একুশ শতকের ধনকুবেরদের নিদেনপক্ষে তাত্ত্বিকভাবে হলেও অধিকতর গণতান্ত্রিক ও ভারসাম্যমূলক জবাবদিহির নীতি থাকে। তাদের ক্ষমতাচর্চার ক্ষেত্র কোনো ছোট অঞ্চল বা দেশের পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাদের বৈশ্বিক করপোরেশনগুলো বিশ্বের সর্বত্র কার্যক্রম বিস্তৃত রাখে। তাদের প্রভাব আমাদের বিশ্ববাসীর সামগ্রিক জীবন, এমনকি এই ধরিত্রীর ভবিষ্যতের ওপরও প্রভাব ফেলে। ইলন মাস্কের মতো ধনীদের শুধু যে তাদের নিজেদের কর্মচারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা নয়, বরং আমাদের সবার জীবনযাপনের ওপরও বিস্তর পরোক্ষ প্রভাব আছে। কার বক্তব্য সামনে আসবে কিংবা কাকে নিষিদ্ধ করতে হবে, সেসব বিষয় তারা ঠিক করার ক্ষমতা রাখেন। মানব সম্প্রদায়ের মনোযোগ কোথায় রাখতে হবে, সে বিষয়ে প্রায়ই তারা অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব খাটিয়ে থাকেন।
মাস্ক তার অজনপ্রিয়তাকে এতটাই অস্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, লোকেরা যদি সিইও পদ থেকে তার পদত্যাগের পক্ষে ভোট দেয় তাহলে তিনি সরে দাঁড়াবেন। লোকেরা তা-ই করল। ৫৭.৫ শতাংশ ভোট পদত্যাগের পক্ষে পড়ল। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করলেন না।
ফলাফলটি স্বীকার করতে মাস্কের ৪০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে এবং ফল মেনে নেওয়ার সময় তিনি বলেছেন, তিনি শুধুমাত্র তখনই পদত্যাগ করবেন যখন তিনি অন্য কোনো যোগ্য কাউকে পাবেন। এটি স্বৈরশাসকদের অতি পুরনো কৌশল। তারা এমন ভান করেন যে, তারা ছাড়া আর গদিতে বসার আর কোনো যোগ্য লোক নেই। এটি তাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার অজুহাত তৈরি করে দেয়। কিন্তু আল-বশিরের সঙ্গে মাস্কের যে বিষয়ে মিল নেই, তা হলো জাহাজ যখন ডুবছে তখনো মাস্ককে তার অনুগতরা ভেসে থাকার সাহস দিয়ে যাচ্ছেন। মাস্ক তার সম্পদের জোরে এই শক্তি পেয়েছেন। কিন্তু এই শক্তি বাজার-শক্তির ওপর নির্ভর করে যাতে কারও পুরোপুরি হাত নেই। বড় বিনিয়োগকারীরা যারা তার বিভিন্ন টেক অ্যাডভেঞ্চারকে সক্ষম করেছেন, তারা অনুগতদের তুলনায় অনেক বেশি চঞ্চল। তারা আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন বিপদের সামান্যতম চিহ্ন দেখলেই তাকে ফেলে ঝাঁপ দেবেন। আল-বশির এবং অন্যান্য পতিত স্বৈরশাসকদের মতো ইলন মাস্ক একই ভুল করছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি জনগণের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখছেন। মাস্কের ডিজিটাল স্বৈরাচারের অবসান ঘটবেই দুদিন আগে হোক বা পরে হোক। কিন্তু তার ত্রুটিপূর্ণ শাসন তার অন্যান্য প্রযুক্তি-ভাইদের জন্য একটি সতর্কতা হিসেবে দাঁড়ানো উচিত যারা প্রযুক্তির স্বৈরশাসক হওয়ার অভিলাষ লালন করেন। তাদের মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট-বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের স্বাধীনতার প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এটি দখল ও নিয়ন্ত্রণ করার যে কোনো চেষ্টা ব্যর্থ হবেই।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
raihan567@yahoo.com